পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-৯)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২৯ নভেম্বর, ২০১৪, ০৬:৪৩:১১ সন্ধ্যা
মিথিলা বাবু!
রায়েরমহলের ভাড়াবাড়িতে চার বছর থেকে নিজেদের একতলা বাড়িতে যখন উঠে যাচ্ছি তখন আমি ক্লাস এইটে। ঘরে উঠার আগের দিন পর্যন্ত 'নিজেদের ঘরে যাচ্ছি' ভেবে যত উত্তেজনা আর প্রস্তুতি সব হঠাৎ ভুলিয়ে মন খারাপ করিয়ে দিল বাড়িওয়ালা। চাবি বুঝে নিতে এসেছিলেন। একবার মনে হল নিজেদের ঘর ফেলে কোথায় যাচ্ছি! আর আসা হবে না! আমাদের এত দিনের ঘর অন্যের হয়ে যাবে! যত বেশি কিছুই পাওয়া যাক, তার বিনিময়েও ছোট কিছুর উপর থেকে অনেক দিনের অধিকার ছেড়ে দিতে দেখলাম কষ্ট হয়।
এইটে উঠতে উঠতে অনেক বন্ধু স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল। টিংকু এবং মজিদ প্রাইমারি শেষ করে আর হাইস্কুলে পড়ল না । টিংকুর বাবা আর একা ঘরের খরচ সামলাতে পারছিলেন না। অবিরাম অভাবের সাথে যুদ্ধে শরীর মন দুইই বোধ হয় ভেংগে যাচ্ছিল। ছেলেকে তখনি গড়ে না নিতে পারলে হয়তো ভর দেয়ার জন্য হাতের কাছে লাঠিটা পাবেন না ভেবেছিলেন। হয়তো কাগজে কালিতে লেখা বিদ্যার উপর ভরসা রাখতে পারলেন না। টিংকু জেলে হয়ে গেল। বাবাকে আশ্বস্ত করার জন্য, বা মা ভাই বোনের ভাত কাপড় আব্রুর জন্য। সে আমাদের আগেই বড় হয়ে গেল!
আর মজিদের অবস্থা টিংকুর থেকে অপেক্ষাকৃত ভালো থাকলেও সে পড়ল না কিছুটা লেখাপড়া মাথায় না ঢুকাতে, কিছুটা অভিভাবকের অবহেলায়। সে তার বাবার ব্যবসার সাথে রইল। টিংকু হল জলের মানুষ, মজিদ হল জাল আর নৌকার মানুষ। 'জাল আগে না জেলে আগে ' চিরকালের এই প্রশ্নের উত্তরে টিংকু বলল ' জেলে আগে', মজিদ বলল, ' জাল আগে'। ভাড়া জাল আর নৌকায় অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সারাদিন, সারা সপ্তাহ বা মাস ভরে মাছ ধরে এনে ও টিংকুর ঘরের অভাব ঘুচত না, টাকা চলে যেত মজিদদের ঘরে। স্কুলের মাঠে খেলা ছেড়ে জীবনের স্বার্থ আর টিকে থাকার সংগ্রামে মুখোমুখি যুদ্ধে পড়ে গেল দুই বন্ধু। মার্বেল বা ফুটবলের কাড়াকাড়িটা যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করেছিল তা তবুও হয়ত গোপনে ক্ষীণ ধারায় মনের ভিতর বইছিল। তারা দুজনেই পরে একই মতে এক পক্ষ হয়ে ন্যায়ের জন্য লড়েছিল।
এভাবে এক এক বন্ধু এক একভাবে এক এক রকম জীবনে জড়িয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে হারিয়ে গেল।
হাইস্কুলে যাবার পরে প্রাইমারি স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে আমার সাথে রইলো শুধু খালেক এবং টুটুল।
আমার ক্লাস এইটের শেষে ছোট খালা বেড়াতে এলেন আমাদের বাসায়। বন্ধুদের আর বাবার কাছ ঘেঁষার অভ্যাস তখনো রয়ে গেছে, তবু অন্য সবার কাছ থেকে একটু দূরে দূরে থাকি। ছোটখালা একদিন পাকড়াও করলেন। মিটমিট হেসে বললেন,' কিরে! বড় হয়ে গেছিস? পাশে আসিস না কেন? দেখি তোর গোফ উঠল কিনা? ' পালিয়ে বাঁচলাম। খালা হেসে শেষ। সেই রাতে খাওয়ার টেবিলে জানলাম খালা আমাদের সাথেই থাকবেন। খালা কখনো কোথাও এক মিনিটের জন্য গেলেও মেহমান হয়ে থাকতে জানতেন না। বেশ অনেকদিন দেখা না হওয়াতে আর ওই বয়সের কারণে আমার মনে যা কিছু সংকোচ আর দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল তা উড়িয়ে দিতে খালার এক সন্ধ্যাই যথেষ্ট ছিল। খাওয়ার পর হাত ধরে পাশে বসিয়ে মজার মজার কথা বলতে লাগলেন। তখন আমাদের ঘর প্রতিবেলা উৎসবের আমেজে ভরপুর হয়ে থাকত। সবার সামনেই ফিসফিস করে গোপন কথা বলার ভংগিতে খালা জানালেন, ' তোরা জানিস, আগামী মাসে আমার বিয়ে! ' ঘরটাতে যারা ছিল তারা সবাই তার গোপন খবরটা যে যার জায়গায় থেকেই শুনতে পেলেন। বাবা হা হা হাসিতে ঘর কাঁপিয়ে দিলেন। বাদল খালার কোলের কাছে আরো ঘেঁষে বসল। খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল খালার বিয়ে হয়ে গেলে তার কানের গয়নার বড় বাক্সটা শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যাবে কিনা। খালা খুব অবাক হয়ে বাদলকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কেন? কানের দুল পরবি? ' আরেক দফা হাসির হুল্লোড় পড়ে যায়। বাদল লজ্জায় কেঁদেকেটে মারপিট শুরু করে দেয়। খালা পরের দিনই বাদলের গয়নার বাক্স'র প্রয়োজন কিসের তা বের করে ফেলেন। আমাদের সবচেয়ে কাছের বাড়ির সোহাগ আপার চুড়ি পরার শখ। ওই বাক্সটাতে একটা চুড়ির আলনা আছে। চিকন তারে বাক্সের সাথে একপাশ লাগানো। আলগা করে চুড়ি রাখতে নিতে হয়। ওটা ওই বক্সের ভিতরে রেখেই বাক্স বন্ধ করা যায়। ওটাতে কানের দুল টুল ও রাখা যায়। সোহাগ আপু বাদলকে খুব আদর করতেন। আমার দুই এক বছরের বড় ছিলেন। ছোট খালার বয়সীই হবে। টেন এ পড়ত। বাদলকে প্রায়ই ঠাট্টা করত, ' তুমি বড় হলে আমি তোমাকে বিয়ে করবো। তোমাকে কিন্তু পাইলট হতে হবে।' আমি এই কথা ফাঁস করে দিতেই ছোট খালা বাদলের পিছে লেগে গেলেন।
ছোট খালার মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্টের ঠিক আগে সত্যি সত্যিই উনার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। আমাদের বাসা থেকেই বাবা ওনাদের বিয়েটা দিয়ে দেন। ছোট খালু তখন কাস্টমস অফিসের কেরানী। বাবা উনাকে চাকরিসূত্রে চিনতেন। ছোট খালু বাবার চেয়ে বয়সে কয়েক বছর ছোট। বিয়ের খুব অল্প সময়ের মধ্যেই খালু বাড়ি গাড়ী করে ফেলেছিলেন। বিয়ের পর ছোট খালাকে খুব সাজগোজ করে থাকতে হতো। ভারী ভারী গয়না, সিল্কের শাড়ী, দামী স্যান্ডেল। বিয়ের আগেও ছোটখালা সাজতে পছন্দ করতেন। মা বলতেন, 'যে যেমন, সে তেমনই পায় '। বিয়ের পরে ছোটখালা আগের চেয়ে আরো বেশি হাসিখুশি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একদিন অনেক রাতে ঘুম ভেংগে আমি খালাকে বারান্দার চেয়ারে বসে খুব কাঁদতে দেখেছিলাম। সেদিন মা খালার পিছনে দাঁড়িয়ে অনেক ক্ষণ খালার মাথায় হাত বুলিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে অনেক কিছু বলেছিলেন। শোবার ঘরের দরজার পাশ থেকে আমিও দুই একটা কথা শুনতে পেয়েছিলাম। মা বলছিলেন, ' কত কিছু মেনে নিতে হয়.. পুরুষ মানুষ.. ঠিক হয়ে যাবে ' বারান্দার অন্য চেয়ারটাতে সেদিন যে ছায়াটাকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখেছিলাম পরে একদিন বুঝেছিলাম, সেই ছায়াটা বাবা ছিল।
বাবার নতুন কাজটা প্রথমে বাবার খুব ভালো লেগেছিল। অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের ঘরে টাকা পয়সা যত বাড়তে লাগল বাবার মুখের হাসিটাও কেমন মুছে যেতে থাকল। বাবা হেসে হেসে মায়ের সাথে প্রায়দিন নানান কথায় যাদের নাম বলতেন ধীরে ধীরে তাদের নাম গুলি বাদ দিতে লাগলেন। কারো কারো নামে এক সময় যেমন উচ্ছ্বসিত হতেন, কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে বেশিরভাগের নাম শুনলেও গম্ভীর হয়ে যেতেন। কখনো কখনো অনেক জোরে ধমক দিতেন। আমরা দু'ভাই আর মা ধীরে ধীরে মনে মনে বাবার কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে এলাম।
ছোট খালা আসা যাওয়া কমিয়ে দিল। আমরা এক ঘরে দুই পরিবারের মত হয়ে গেলাম। মা,আমি আর বাদল এক দিকে অন্যদিকে বাবা একা। আর্থিক স্বচ্ছলতা যখন প্রাচুর্য্যের ঘরে পৌঁছল তখন আমাদের ঘরে কারো সাথেই আর কারো তেমন কোন লেনদেন নাই। আগের চেয়ে অনেক বেশি ইচ্ছামত টাকা খরচ করি, অনেক নতুন বন্ধু হল। অনেক নতুন অভ্যাস হল। টাকা অনেক রকম লোকজনকে আমাদের কাছে নিয়ে এলো। আবার সেই টাকাই বাবা আর আমাদের মাঝখানে দেয়াল তুলে দিল।
ইনকাম ট্যাক্স বোধ হয় সারা দুনিয়ায় সব সময়েই দেশের সব চেয়ে করাপ্টেড ডিপার্টমেন্টগুলির একটা। দুনিয়াতে দুর্নীতি তেলাপোকার মতই টিকে থাকে। কিছু কিছু লেনদেন আর পেশা বোধ হয় স্যাঁতস্যাঁতে হয়। ওখানে ওই তেলাপোকা কলোনী করে ঘর বাড়ি সমাজ সংসার করে। সিস্টেমটাই এমন ছিল - একটু ও সচেতন হওয়ার আগেই বাবা পিছলে গিয়েছেন। সত্য হল, এই জগতে পা রাখার সাথে সাথেই তিনি এর অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। কিছু ক্ষেত্রে বাধ্য হয়েছেন। আবার ক্ষমতা ও কিছু পেয়েছিলেন যা উপভোগ্য ছিল। অসতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন টেরই পাননি। যখন বুঝলেন, তখন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছেন।
কিছু মানুষ থাকেন, যত অতলেই তলিয়ে যান না কেন - ঠিকই ভেসে ওঠেন। ভেসে ওঠার আগে যে চাপটা লাগে তা ভয়ানক।
এক সন্ধ্যায় বাবা মা কথা বলছিলেন। বাবাকে সেদিনের মত মন খারাপ করতে কমই দেখেছি। আমি একটা ঘুড়ি বানাচ্ছিলাম। অনেক দিন পর সন্ধ্যায় বারান্দায় পাশাপাশি চেয়ারে বসে গল্প করছিলেন বাবা মা।
বাবা বললেন, ' শহরে এসে টিকে থাকার সংগ্রামে জয়ী হতে হলে নিজের হৃদয়ের ভালোলাগাগুলোকে গলা টিপে মেরে ফেলতে হয়। উপায় নাই।
স্কুলের মত সুন্দর জায়গায় ও দূর্নীতি দলাদলি, চেষ্টা তো করলাম, কিন্তু কই থাকতে পারলাম না নিরিবিলি। সরকারি প্রতিটি অফিসে এই দূর্নীতি একটা ওপেন সিক্রেটের মত ছড়িয়ে আছে। এই চাকুরিও ছেড়ে অন্য যেটায় ই যাই, একই ব্যাপার। যাবো কোথায়? গ্রামেও একই অবস্থা।
তবে কি চাকুরি ই বাদ দিবো? ব্যবসা করব? সেখানেও কি টিকতে পারবো? এরকম ভাবে হেরে যেতে থাকলে গ্রামে আমার বড় দুই ভাই টিটকারি মারবে, ওদের কথার জ্বালা আর নিজের ব্যররথতার জ্বালা সব মিলে আমাকে পাগল করে দিবে।'
তোমার দাদাভাইয়ের হতাশ কথাগুলি আমাকে খুব কষ্ট দিল। বাবা হেরে গেলেন?
শুনলাম তোমার দাদাভাইয়ের কথায় তোমার দাদী বললেন, "তুমি দুই ছেলের কথা চিন্তা কর। আরো একজন যে আসছে, তার কথাও ভাবো।'
তখনো তোমার ফুফুর জন্ম হয়নি।
ইতিমধ্যে দেশেও ঘটনা অঘটন অনেক হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট জিয়া চট্টগ্রামে সার্কিট হাউসে মর্মান্তিক ভাবে অতর্কিতে নিহত হন।
জিয়াউর রহমানের আমল শেষ হয়ে দেশের ক্ষমতা কয়েকবার হাত বদল হয়ে যায়। দেশে মার্শাল ল' চলে আসে।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১০৮০ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শুভ সন্ধ্যা।
সহমত আপনার সাথে।
সাথে থেকে অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলেন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অর্থের প্রাচুর্য্য জীবন চলায় জরুরী বটে!তবে সাধারণ ভাবেই আত্মার প্রশান্তি খুজে পেতে কষ্ট হয় তখন!
ততক্ষণে অক্টোপাশে বন্ধি!
বরাবরের মতই উপভোগ্য উপস্হাপনায় অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহু খাইরান মামুন ভাই!!
সাথে থাকার জন্য শুভেচ্ছা।
বারাকাল্লাহু ফিকুম।
একদম সত্য বলেছেন মামুন ভাই। মানুষের ভিতর মানবিক গুণগুলি মরে যায়। মানুষ হয়ে পড়ে অনুভূতিহীন। যেমন আমি। সুন্দর হয়েছে চালাতে থাকুন।
শুভকামনা রইলো ভাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন